সুলতানি আমল (Delhi Sultanate)

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত ও নিহত করেন। এরপর তিনি তার বিশ্বস্ত অনুচর তথা সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবককে ভারতের উত্তরসূরি হিসাবে নিযুক্ত করেন এবং নিজে দেশে ফিরে যান। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে ঝিলাম নদীর তীরে মহম্মদ ঘুরির মৃত্যু হলে পরবর্তী ঘুর রাজ্যের শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কুতুবউদ্দিন আইবেককে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে 'সুলতান' উপাধি প্রদান করেন।এইভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে কুতুবউদ্দিন আইবেকের নেতৃত্বে ভারতের দিল্লীতে সুলতানি শাসনের সূচনা হয়। সুলতানি আমলে পর পর পাঁচটি রাজবংশ দিল্লির সিংহাসনে ক্ষমতাসীন ছিল । সেই পাঁচটি রাজবংশ হল —
(ক) ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইলবেরি তুর্কি বংশ বা দাসবংশ [Slave Dynasty]।
(খ) ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলজি বংশ [Khalji Dynasty] ।
(গ) ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তুঘলক বংশ [Tughlaq Dynasty]।
(ঘ) ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ বংশ [Sayyid Dynasty]।
(ঙ) ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লোদী বংশ [Lodi Dynasty] ।

দাসবংশ

নামকরণঃ

তিনি ও তাঁর উত্তরাধিকারীরা 'ইলবেরি তুর্কি' গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন বলে এদের রাজত্বকাল ইতিহাসে 'ইলবেরি তুর্কি' আমল হিসাবে পরিচিত ।

সুলতান কুতুবউদ্দিন নিজে এবং তাঁর পরবর্তী আরও দুই জন সুলতান প্রথম জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন, তাই কুতুবউদ্দিন থেকে কায়েকাবাদ পর্যন্ত (অর্থাৎ ১২০৬ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) দিল্লির সুলতানদের দাসবংশ [Slave Dynasty] বলা হয়ে থাকে ।

কুতুবউদ্দিন আইবক (Qutb -ud-din Aibak)[1206-10]

  • মহম্মদ ঘুরীর সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী রূপে কুতুবউদ্দিন আইবক দিল্লির সিংহাসনে বসেন ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি নিজেকে “মালিক” ও “সিপাহশালার” উপাধিতে পরিচয় দিতেন।
  • ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরির উত্তরাধিকারী গিয়াসউদ্দিন ঘুর তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে “সুলতান” উপাধিতে ভূষিত করেন।
  • তাঁর দানশীলতার জন্য তিনি ইতিহাসে “লাখবক্স” নামে পরিচিত।
  • বিখ্যাত ঐতিহাসিক হাসান নিজামি এবং ফকর – ই – মুদাব্বির তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
  • রাজপুতদের পরাজিত করে জয়ের আনন্দে ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে “কোয়াত – উল – ইসলাম”/ কুতুব মসজিদ ( Might of Islam)তৈরি করেন।
  • বিখ্যাত সুফি সাধক কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নাম অনুসারে দিল্লিতে বিখ্যাত “কুতুব মিনার” তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করে যেতে পারেন নি। শেষ করেছিলেন তাঁর জামাতা ইলতুতমিস।
  • আজমিরে তৈরি করেন- "আড়াই দিন কা ঝোপড়া"
  • ১২১০ খ্রিস্টাব্দে চৌগান(পোলো) খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ ঠেকে পরে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

আরাম শাহ[1210-1211]

  • কুতুবুদ্দিন এর মৃত্যুর পর লাহোরের ওমরাহগণ তাঁর পালিত পুত্র আরাম শাহ কে লাহোরের সিংহাসনে বসান।
  • আরাম শাহ সাম্রাজ্য পরিচালনায় অদক্ষ ছিলেন। তাঁর অকর্মন্যতার সুযোগে সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দে়য়।
  • দিল্লির আমির ওমরাহগণ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং কুতুবুদ্দিন এর জামাতা তথা বদাউন প্রদেশের শাসনকর্তা ইলতুতমিস কে সিংহাসনে বসার আমন্ত্রণ জানান। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ইলতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত ও নিহত করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন ।

ইলতুতমিস[1211-36]

  • প্রকৃত নাম ছিল সামসুদ্দিন আলতামাস। তিনি ছিলেন তুর্কি স্থানের ইলবারি গোষ্ঠীভুক্ত এক অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু তাঁর ভাইরা ইর্ষাবশত তাঁকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেন। কুতুবউদ্দিন তাঁকে ক্রীতদাস হিসাবে ক্রয় করেন ।
  • পরে তাঁর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ও নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন ।
  • ১২১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির সিংহাসনে বসেন। কুতুবুদ্দিন এর মৃত্যুর পর যে সমস্ত অঞ্চলে বিক্ষোভ শুরু হয় সেইসব তিনি দমন করেন এবং নতুন কিছু অঞ্চলেও দিল্লি সুলতানির আধিপত্য সম্প্রসারিত করেন।
  • ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা তাঁকে “সুলতান – ই – আজম” বা প্রধান সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন। ইলতুতমিস খলিফার নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলন করেন এবং মুদ্রায় নিজেকে ” খলিফার সেনাপতি ” বলে উল্লেখ করেন।
  • ঐতিহাসিক লেনপুল তাঁকে “দাস বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা” বলে উল্লেখ করেছেন। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গোল নায়ক চেঙ্গিস খাঁ খিবার অধিপতি জালালউদ্দিন মঙ্গবর্ণীর পিছু ধাওয়া করলে মঙ্গবর্ণী ইলতুতমিসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ইলতুৎমিস বিচক্ষনতার পরিচয় দিয়ে এই আবেদন অগ্রাহ্য করেন । ফলে মঙ্গবার্নি ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ও চিঙ্গিস খানের অনিবার্য আক্রমণ থেকে ভারত রক্ষা পায় ।
  • তুর্কান-ই-চাহেলগান/বন্দেগান-ই-চাহেলগান(চল্লিশ চক্র) প্রবর্তন করেন।
  • ইক্তা প্রথার প্রবর্তন করেন।
  • রূপার মুদ্রা‘তঙ্কা’এবং তামার কয়েন 'জিতল' চালু করেন।
  • তিনি দিল্লির বিখ্যাত কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করেন ।
  • ১২৩০ সালে তিনি মেহরাউলিতে হাউজ-ই-শামসি নামক জলাধার নির্মাণ করেন।
  • ১২৩১ সালে তিনি দিল্লিতে প্রথম মুসলিম সমাধি সুলতান গারি নির্মাণ করেন।
  • জামে মসজিদ শামসি তৈরি করেন।
  • Gandhak-ki-Baoli নামে Stepwell তৈরি করেন।
  • তরাইনের তৃতীয় যুদ্ধে () তাজউদ্দিনকে পরাস্ত করেন।
  • তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর জেষ্ঠ্য-পুত্র নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু হলে তিনি অন্য কোনো পুত্র কেই তাঁর সিংহাসনের উপযুক্ত মনে করেন নি। তাই তিনি তাঁর কন্যা রাজিয়াকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনীত করেন।

রুকুনুদ্দিন ফিরোজ

  • ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইলতুতমিসের মৃত্যুর পর তাঁর মনোনয়ন অস্বীকার করে দিল্লির আমির ওমরাহরা সুলতান পুত্র রুকুনুদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসতে সহায়তা করেন।
  • রুকুনুদ্দিন ফিরোজ অদক্ষ শাসক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের চতুর্দিকে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় রাণীমাতা শাহ তুরকান শাসন ক্ষমতা হস্তগত করেন।
  • রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে দিল্লির অভিজাত শ্রেণী ও আমির ওমরাহগণ রুকুনুদ্দিন ফিরোজ ও রাণীমাতা শাহ তুরকানকে পরাজিত করে রাজিয়া সুলতানকে দিল্লীর সিংহাসনে বসান।
  • তিনি মাত্র সাত মাস রাজত্ব করেন।

রাজিয়া সুলতান[1236-40]

  • সুলতান রাজিয়া ছিলেন ভারতের প্রথম ও শেষ মহিলা সুলতান।
  • নারী হয়েও তিনি সমস্ত প্রকার পুরুষোচিত গুণের অধিকারী ছিলেন। শাসনকার্য পরিচালনা, যুদ্ধবিদ্যা, দয়া দাক্ষিণ্য সব দিক দিয়েই তিনি কৃতী ছিলেন। তিনি পুরুষের মত পোষাক পরতেন এবং একজন সম্রাটের মত প্রকাশ্য দরবারে উপস্থিত হতেন। সেই সময়ের পর্দা প্রথা তিনি মানতেন না এবং তাঁর সরকারি মুদ্রাতে 'সুলতান' খেতাব ব্যবহার করতেন ।
  • মধ্য যুগের গোঁড়া মৌলবি এবং অভিজাতদের কাছে এসব ছিলো ব্যভিচারীর সামিল ফলে তাঁরা রাজিয়া কে সিংহাসন চ্যুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁকে সিংহাসন হারাতে হয়।

পরবর্তী সুলতানঃ

  • রাজিয়ার পর দিল্লির আমির ওমরাহরা ইলতুতমিসের তৃতীয় পুত্র মুইজ উদ্দিন বাহরাম শাহ কে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু কিছুদিন পর তিনিও সিংহাসনচ্যুত হন।
  • এরপর আলাউদ্দিন মাসুদ শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন আরামপ্রিয়, অযোগ্য শাসক। তাঁর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে দিল্লির আমিররা তাঁকে সিংহাসন চ্যুত ও হত্যা করে
  • এরপর ইলতুতমিসের জেষ্ঠ্য পুত্র নাসিরুদ্দিনের পুত্র নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ-কে[১২৪৬-৬৬] সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি পরিপূর্ণ ভাবে তুর্কি দাস কর্মচারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

উলুগ খাঁ / বলবন[১২৬৬-৮৬]

  • বলবনের প্রকৃত নাম ছিল বাহাউদ্দিন। বলবনের রাজ উপাধি ছিল গিয়াসউদ্দিন।
  • দিল্লীর সুলতান ইলতুতমিস বলবনকে একজন দাস ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রয় করেন এবং চল্লিশ চক্রে অন্তর্ভুক্ত করেন।
  • বলবন ইলতুতমিসের 'খাসবরদার' বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন।
  • সুলতান রাজিয়ার আমলে তিনি ছিলেন আমির-ই-শিকার।
  • মুইজ উদ্দিন বাহরাম এবং আলাউদ্দিন মাসুদের শাসন আমলে তিনি 'আমির-ই-হাযিব' বা রাজগৃহাধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
  • ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন “নায়েব – ই – মামলিকাত” বা সুলতানের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন এবং সুলতান নাসিরউদ্দিন মামুদের সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ প্রদান করেন।
  • ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের মৃত্যু হলে তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও শ্বশুর উলুগ খাঁ সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি নতুন রাজকীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও চল্লিশ চক্রের উচ্ছেদ সাধন করেন। নিজেকে “নায়েব – ই – খুদাই” বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেন এবং ঈশ্বরের ছায়া বা “জিলিল্লাহ” উপাধি গ্রহণ করেন।
  • পারসিক দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনি দরবারে ”পাইবস ”(সুলতানের পায়ে চুম্বন করা তার শক্তি স্বীকার করা) ও ”সিজদা ”(নতজানু হয়ে সম্রাটকে প্রণাম) প্রথা চালু করেন।
  • তিনি দরবারে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রাখতেন। আমোদ প্রমোদ , হাস্যকৌতুক , মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষেধ ছিল।
  • তিনি একমাত্র উজির ছাড়া আর কারও সাথে কথা বলতেন না। তিনি প্রচুর পরিমাণে “বারিদ” বা গুপ্তচর নিয়োগ করেন।
  • “ভারতের তোতাপাখি ” নামে পরিচিত আমির খসরু এবং ঐতিহাসিক হাসান নিজামি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন।
  • গিয়াসউদ্দিন বলবন প্রথম ভারতে পার্সিয়ান উৎসব নওরোজ(Nauroz/Novroz)চালু করেন।
  • ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাঁর পুত্র মহম্মদের মৃত্যু হয়।
  • গিয়াসুদ্দিন বলবন দিল্লি ও তার সন্নিকটস্থ অঞ্চলে মেওয়াটী দস্যুদের দমন করেন।
  • ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন বলবন মৃত্যু বরণ করেন।

মৃত্যুর পূর্বে কনিষ্ঠ পুত্র বুঘরা খান কে তিনি তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। বুঘরা খান অসম্মত হলে মহম্মদের পুত্র কাইখসরু কে উত্তরাধিকারী মনোনীত করা হয়।

কাইখসরুর মৃত্যুর পর অভিজাত ব্যক্তিরা কায়কোবাদকে সুলতান মনোনীত করে।

মুইজউদ্দিন কায়কোবাদ অল্পবয়সে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তার তেমন মনোযোগ ছিল না।

অতঃপর দিল্লীর মসনদ ঘিরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সম্রাটের আফগান আমির জালালউদ্দিনের অনুচর কলিঘিরির প্রাসাদে ঢুকে কায়কোবাদকে হত্যা করে।

কাইকোবাদের পরে তুর্কী অভিজাতগন তার তিন বছরের পুত্র কায়ুমার্সকে সিংহাসনে বসান। কায়ুমার্স-এর উপাধি ছিল“দ্বিতীয়সামসুদ্দিন’। কায়ুমার্স –এর প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয় জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজীকে। 1290 খ্রিঃ 13জুন দাস বংশের শেষ সুলতান শিশু কায়ূর্মাসকে হত্যা করে জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজী নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন(70 বছর বয়সে)।

খলজী বংশ

জালালউদ্দিন খলজি[১২৯০-৯৬]

  • দাস বংশের শেষ সুলতান কায়কোবাদ ও তাঁর শিশুপুত্র কায়ুমার্স কে হত্যা করে দিল্লীতে খলজি শাসনের সূচনা করেন।
  • খলজি বিপ্লবের প্রবর্তক।
  • তিনি নিজ কন্যার বিবাহ দেন ভ্রাতুষ্পুত্র আলাউদ্দিন খলজির সঙ্গে।

আলাউদ্দিন খলজি

  • জালালউদ্দিন খলজিকে হত্যা করে নিজেকে দিল্লীর পরবর্তী সুলতান বলে ঘোষণা করেন ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে ।
  • জালালউদ্দিন এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শিহাবউদ্দিন এর পুত্র আলাউদ্দিন খলজি সিংহাসনে বসার পর ” আলাউদ্দিন মহম্মদ শাহ উস সুলতান” উপাধি ধারণ করেন।
  • আলাউদ্দিন খলজির প্রকৃত নাম ছিল আলি গুরসাস্প।
  • জালালউদ্দিন খলজির শাসনকালে তিনি কারা ও মানিকপুরের শাসনকর্তা ছিলেন।
  • আলাউদ্দিন নিজেকে খলিফার সহকারী (ইয়াসিন – উল- খিলাফত) বা সমমর্যাদার অধিকারী বলে মনে করতেন।
  • ভারতের তুর্কি শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজিই প্রথম দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে নজর দেন। তাঁর অর্থনৈতিক সংস্কারের দুটি দিক ছিল রাজস্ব সংস্কার এবং বাজার দর নিয়ন্ত্রণ। তাঁর এই অর্থনৈতিক সংস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যায় জিয়াউদ্দিন রচিত “তারিখ ই ফিরোজ – শাহি” ও “ফতোয়া – ই – জাহান্দারি” এবং আমির খসরু রচিত “খাজাইন – উল – ফুতুহা” থেকে।
  • রাজস্ব সংস্কার
    • তিনি সকল প্রকার জমি বাজেয়াপ্ত করে “খালিসা” বা সরকারের খাস জমিতে পরিণত করেন। খালিসা জমির মাধ্যমে কৃষকদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। “আমিল” নামক সরকারি কর্মচারীরা এইসব জমি থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায় করতো।
    • তিনি খুৎ, মুকাদ্দম , চৌধুরী প্রভৃতি রাজস্ব কর্মচারীগণ খাজনা বিহীন যেসব ভূমি দখল করে আসছিলেন তা বাতিল করা হয়।
    • আলাউদ্দিন প্রথম জমি জরিপ ব্যবস্থা প্রচলিত করেন ।
    • আলাউদ্দিনখলজি অ-মুসলমানদের জন্য ‘জিজিয়া’ ও মুসলমানদের জন্য খামস ও জাকাৎ নামক কর প্রবর্তন করেছিলেন।
  • দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি চারটি বিশেষ ধরনের বাজার গড়ে তোলেন। বাজার দেখাশুনার জন্য আলাউদ্দিন 'শাহানা-ই-মান্ডি' কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন।
    • মাণ্ডি — যেখান থেকে গম, ডাল, বার্লি প্রভৃতি সরকার নিয়ন্ত্রিত মূল্যে পাওয়া যেত।
    • সেরা – ই – আদল—- এই বাজার থেকে বস্ত্র, চিনি, ফল, ওষুধপত্র পাওয়া যেত।
    • ঘোড়া, গবাদি পশু, ক্রীতদাসদের বিক্রির জন্য একটি বাজার ছিল।
    • সমগ্র দিল্লি শহর জুড়ে ছোটোখাটো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রচুর বাজার ছিল। এখানে মাছ, মাংস, তরকারি, টুপি ইত্যাদি বিক্রি হতো।
  • সামরিক সংস্কার
    • তিনিই প্রথম সম্রাট যিনি একটি স্থায়ী সেনাদল গঠন করেন।
    • সেনাবিভাগের দায়িত্ব অর্পিত হয় “আর্জ ই মামালিক” নামক সমর মন্ত্রীর উপর।
    • আলাউদ্দিনখলজি ইক্তা ব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন অর্থাৎ সেনাদের জায়গিরের পরিবর্তে নগদ বেতন (বার্ষিক 234 টাকা) দেওয়ার রীতি চালু করেন।
    • আলাউদ্দিন খলজি “হুলিয়া” ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যার দ্বারা তিনি প্রত্যেক সৈন্যের দৈহিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। আলাউদ্দিন খলজি আরেকটি “দাগ” প্রথার প্রবর্তন করেন যার মাধ্যমে তিনি ঘোড়ার দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী ঘোড়ার গায়ে লোহা পুড়িয়ে দাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
  • ‘বারিদ’,‘মুনহি’, ‘জাসুস’ প্রভৃতি নানা শ্রেণীর গুপ্তচরদের নিযুক্ত করা হয়।
  • ব্যবসায়ীদের নাম নক্তিভুক্তকরণ ও তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাউদ্দিন খলজি “দেওয়ান-ই-রিয়াস” নিয়োগ করেছিলেন।
  • মদ্যপান নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। তিনি নিজে মদ্যপান ত্যাগ করেন। তিনি জুয়ো খেলা ও ভাং খাওয়ার উপর-ও নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।
  • রেশনিং ব্যাবস্থার মূল প্রচলন এই আলাউদ্দিন খলজিই করে গেছেন।
  • আউলাখ বা অশ্বারোহী ডাকের প্রচলন করেছিলেন আলাউদ্দিন খলজি।
  • আলাউদ্দিনের সেনাপতি মালিক কাফুর পাণ্ড্য রাজ্য আক্রমণকালে বিখ্যাত রামেশ্বর মন্দির ধ্বংস করেছিলেন।
  • সিংহাসনে আরোহণের পর আলাউদ্দিন ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম গুজরাটের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠান। এই সময় গুজরাটের সিংহাসনে ছিলেন বাঘেলা রাজপুত বংশীয় কর্ণদেব। সুলতানী সেনাবাহিনী কোনরকম যুদ্ধ না করেই রাজধানী দখল করেন। আলাউদ্দিন গুজরাটের রাজা কর্ণদেবের পত্নী রানী কমলা দেবীকে বন্দি করেন ও পরে বিবাহ করেন। কর্ণদেব তাঁর কন্যা দেবলাদেবী সহ দাক্ষিনাত্যের দেবগিরি রাজ্যে আশ্রয় লাভ করেন। গুজরাট অভিযানের সময় আলাউদ্দিনের বাহিনী সোমনাথ মন্দির মন্দিরটি লুণ্ঠন করে।
  • এরপর আলাউদ্দিন রাজপুত রাজ্য রনথম্বোর এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে চৌহান বংশীয় তৃতীয় পৃথ্বীরাজ এর বংশধর হামিরদেবকে সপরিবারে হত্যা করেন।
  • এরপর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চাশ হাজার সেনা নিয়ে আলাউদ্দিন খলজি মেবারের রাজধানী চিতোর এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তখন মেবারের অধিপতি ছিলেন শিশোদিয়া রাজবংশের রানা রতন সিংহ। গুজরাট অভিযানের সময় এই রতন সিংহ আলাউদ্দিন কে বাধা দেন তাই তিনি গুজরাট দখল করে মেবার আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। মেবার আক্রমণের কারণ হিসাবে কেউ কেউ বলেন যে রানা রতন সিংহ এর পরমা সুন্দরী রানী পদ্মিনী কে লাভ করার জন্যই তিনি মেবার আক্রমণ করেন। চিতোর জয়ের ২৩৭ বছর পর মালিক মোহাম্মদ জয়সী তাঁর “পদ্মাবৎ” কাব্যে এই ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন। অবশ্য এই সম্পর্কে ঐতিহাসিক দের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কারণ আলাউদ্দিনের সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা যেমন আমির খসরু, ইসামি বা বরনির লেখায় এর কোনো উল্লেখ নেই।
  • চিতোর জয়ের পর তিনি তাঁর নাবালক পুত্র খিজির খাঁ এর উপর সমস্ত দায়িত্ব অর্পণ করে দিল্লি ফিরে যান। খিজির খাঁ এর নামানুসারে চিতোরের নামকরণ করেন খিজিরাবাদ।
  • মালিক কাফুরের(পূর্বনাম মাণিক সিংহ এবং তিনি ছিলেন গুজরাটের হিন্দু বংশজাত একজন ব্যক্তি) সাহায্যে আলাউদ্দিন খলজি দিল্লির সুলতানদের মধ্যে সর্বপ্রথম দক্ষিন ভারত জয় করেছিলেন। কাফুর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ প্রতাপ রুদ্র, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করবার পর ভাতৃবিরোধের সুযোগ নিয়ে পান্ড্য রাজ্য অধিকার করেন । এরপর তিনি নাকি রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হন ।
  • আলাউদ্দিন নিজেকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বা ‘সিকান্দর-ই-সানি’বলে মনে করতেন ।
  • “ভারতের তোতাপাখি ” নামে পরিচিত আমির খসরু(আসল নাম আবুল হাসান আমীনউদ্দি ন খুসরভ) এবং ” ভারতের সাজি ” নামে পরিচিত আমির হাসান তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন।
  • তাঁর স্থাপত্যের মধ্যে আলাই দরওয়াজা(কুতুব মিনারের প্রবেশদ্বার), হাজার সেতুন বা এক হাজার থামের প্রাসাদ, আলাই মিনার, Hauz-i-Khas/Hauz-i-Alai নামে একটি জলাধার উল্লেখযোগ্য। দিল্লির উপকন্ঠে তিনি “সিরি” নামে একটি শহর স্থাপন করেন।
  • আলাউদ্দিন খলজি 1316 খ্রি. 5 জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজী মৃত্যুর পূর্বে তাঁর পুত্র শিহাবউদ্দিন ওমর(ঝাট্যপল্লীর গর্ভজাত সন্তান)কে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। মালিক কাফুর আলাউদ্দিনের নাবালক পুত্র শিহাবউদ্দিন ওমর কে সিংহাসনে বিসিয়ে নিজে সকল ক্ষমতা দখল করেন এবং শিহাবউদ্দিনের মাতা ঝাট্যাপল্লীকে বিবাহ করেন। আলাউদ্দিন এর তৃতীয় পুত্র কুতুবউদ্দিন মোবারক খলজী মালিক কাফুরকে হত্যা করে দিল্লির মসনদে বসেন। 1320 খ্রি. 13 এপ্রিল খসরু খান কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহকে হত্যা করে নাসিরুদ্দিন খসরুশাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। খসরু খানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আমির ওমরাহরা পাঞ্জাবের শাসন কর্তা গাজি মালিককে দিল্লীর মসনদ দখলের জন্য আহ্বান জানান। গাজী মালিক(গিয়াসউদ্দিন তুঘলক) প্রথমে সরস্বতী ও পরে ইন্দ্রপ্রন্থ বা লাইরাবাটের যুদ্ধে খসরু খান (নাসিরুদ্দিন খসরুশাহ) কে পরাজিত ও নিহত করেন এবং দিল্লীতে তুঘলক বংশের শাসনের সূচনা করেন।

তুঘলক বংশ

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক[১৩২০-২৫]

  • ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন “তুঘলক শাহ গাজি” উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।
  • প্রথম জীবনে নাম ছিল গাজি মালিক।
  • দিল্লির সুলতানদের মধ্যে তিনিই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে “গাজি” উপাধিটি যোগ করেছিলেন।
  • তিনি দিল্লির অদূরে তুঘলকাবাদ নামে একটি নতুন শহরের পত্তন করেন।
  • আলাউদ্দিন যে ” হুকুম – ই – মাসাহাত” বা জমি জরিপের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণ প্রথা চালু করেছিলেন তিনি তা বাতিল করে ” হুকুম – ই – হাসিল ” বা রাজস্ব কর্মীর উপস্থিতিতে উৎপন্ন শস্য ভাগ করার ব্যাবস্থা চালু করেন। ৫০ শতাংশ ভূমি রাজস্ব এর বদলে এক দশমাংশ ভূমি রাজস্ব ধার্য করেন।
  • অনাবৃষ্টির সময় কৃষক দের “তকাভি” ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
  • কাঠের মঞ্চ থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

মহম্মদ বিন তুঘলক[1325-51]

  • পিতা গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর তিনদিন পর তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র জুনা খাঁ মহম্মদ বিন তুঘলক নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন।
  • জিয়াউদ্দিন বরনি লিখিত “তারিখ – ই – ফিরোজ শাহি”, মহম্মদ ইসামি রচিত “ফুতুহ উস সালাতিন ” এবং ইবন বতুতা রচিত “রেহেলা” এইসব গ্রন্থ থেকে তাঁর আমলের ইতিহাস জানা যায়।
  • দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর: উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ক্রমাগত মোঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা, দেবগিরির সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান, দক্ষিণ ভারতে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার প্রভৃতি কারনে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং দেবগিরির নতুন নামকরণ করেন “দৌলতাবাদ”
  • খোরাসন অভিযান: উচ্চাকাঙ্খী সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক মধ্য এশিয়ার খোরাসান ও ইরাক জয়ের পরিকল্পনা করে প্রায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী গঠন করেন এবং এক বছর ধরে তা পোষণ করেন । কিন্তু পরবর্তী কালে পথের দূর্গমতার কথা চিন্তা করে তিনি এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। এরফলে একদিকে যেমন দিল্লির জনসাধারণ তাঁর কার্য কলাপকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে অন্যদিকে তেমনি রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থের অপচয় হয়।
  • কারাচিল অভিযান:১৩৩৭ – ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিমালয়ের কোলে অবস্থিত কুমায়ুন বা গা গাড়োয়াল রাজ্য জয়ের জন্য একটি অভিযান পাঠান। মহম্মদ তুঘলক এর ভাগ্নে খসরু মালিকের নেতৃত্বে এই অভিযান প্রেরিত হয়। ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাত এবং পার্বত্য জাতির আক্রমণে তাঁর এই অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। অবশ্য সামরিক অভিযান ব্যর্থ হলেও পার্বত্য উপজাতিরা সুলতান কে কর প্রদানে সম্মত হয় এবং সমতলে লুণ্ঠন বন্ধ করে দেয়।
  • প্রতীক মুদ্রা প্রচলনঃসুলতানের অপরিমিত দান খয়রাত, রাজধানী পরিবর্তন, বিদ্রোহ দমন, বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা প্রভৃতি কারণে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। এই অর্থ সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তিনি রৌপ মুদ্রার পরিবর্তে স্বল্প মূল্যের ধাতু ব্যাবহার করে একধরনের “প্রতীক মুদ্রা” প্রচলন করেন। সহজলভ্য ধাতু দ্বারা মুদ্রা তৈরি হওয়ার ফলে দেশ জাল মুদ্রায় ভরে যায়। বিদেশি বণিকরা এই মুদ্রা নিতে অস্বীকার করে। ব্যাবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিন বছর চলার পর শেষ পর্যন্ত তিনি এই মুদ্রা প্রত্যাহার করে নেন। বিনিময়ে জন সাধারণ কে রৌপ্য ও স্বর্ণ মুদ্রা প্রদান করেন। এরফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে।
  • দোয়াবে ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি:সাম্রাজ্যের আয় বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সুলতান গঙ্গা যমুনার দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব এর হার বহুগুণ বৃদ্ধি করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অনাবৃষ্টির ফলে সেইসময় কৃষকদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে। কৃষকরা এই বর্ধিত কর দিতে না পেরে বন জঙ্গলে পলায়ন করে ও দস্যুবৃত্তি গ্রহণ করে। এরফলে কৃষিকাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। জনসাধারণের দুর্দশার সংবাদ পাওয়ার পরে পরেই সুলতান তাদের অর্থ, খাদ্য এবং বলদ সাহায্য দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন। সরকারি খরচে বহু কূপ ও খনন করেন। কৃষি উন্নয়নের জন্য “দেওয়ান – ই – কোহ” নামে স্বতন্ত্র কৃষি দপ্তরস্থাপন করা। কিন্তু মহম্মদের এই দপ্তর আগাগোড়ায় এই কাজে উদাসীন ছিল। এইসব কারনের জন্যই শেষ পর্যন্ত তুঘলক-এর এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
  • বিদ্রোহী তাঘীর বিরুদ্ধে অভিযান ই ছিল মহম্মদ বিন তুঘলক – এর জীবনের শেষ সামরিক কর্মসূচি। সুলতান তাঁর পিছন ধাওয়া করতে করতে থাট্টার সন্নিকটে সোন্ডা নামক স্থানে পৌঁছে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
  • দাক্ষিনাত্যের একটি যুদ্ধে কল্যাণের হিন্দু মন্দির ধ্বংস হলে তিনি তা পুনঃনির্মাণ করেন। রাজশেখর ও জিন প্রভাসুরী নামে দুজন জৈন পণ্ডিত সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন।
  • মরক্কোর বাসিন্দা ইবন বতুতা মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্ব কালে ভারত ভ্রমণ করেন এবং রেহালা নামে একটি বই রচনা করেন।
  • মহম্মদ বিন তুঘলকের সময় যে সকল স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
    • আহসান শাহ-এর নেতৃত্বাধীন মাদুরাই সাম্রাজ্য(১৩৩৫)
    • হরিহর ও বুক্কার নেতৃত্বাধীন বিজয়নগর সাম্রাজ্য(১৩৩৬)
    • হোসেন গঙ্গু/ আলাউদ্দিন বাহমান শাহ-এর নেতৃত্বাধীন বাহমানী সাম্রাজ্য(১৩৪৭)

ফিরোজ শাহ তুঘলক

  • তাঁর মৃত্যুর পর আমির – ওমরাহ ও অভিজাত রা সুলতানের খুল্লতাত পুত্র ফিরোজ তুঘলক কে সিংহাসনে বসার অনুরোধ জানান। ফিরোজ তুঘলক ৪৬ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি খলিফার অনুমোদন অর্জন করেন এবং নিজেকে “খলিফার ভৃত্য” বলে ঘোষণা করেন।
  • যেহেতু অভিজাত দের সমর্থন নিয়ে তিনি সিংহাসনে বসেন তাই তিনি ইক্তাগুলিকে বংশানুক্রমিক জাইগির এ পরিণত করেন।
  • “দার – উল – সিফা” নামে এক চিকিৎসালয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণের ব্যাবস্থা করেন।
  • দুঃস্থ পরিবারের বিবাহযোগ্য মেয়েদের বিবাহে অর্থসাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্যে সুলতান ” দেওয়ান – ই – খয়রাত ” নামে একটি দপ্তর গঠন করেন। দেশের যোগ্য ব্যক্তিদের অর্থ সাহায্য করার জন্য তিনি “দেওয়ান – ই – ইস্তিহক” নামে আরও একটি দপ্তর স্থাপন করেন।
  • বিদ্যাচর্চা ও বিদ্বান ব্যাক্তির প্রতি ফিরোজের অনুরাগের অভাব ছিল না। তাঁর আনুকূল্যে জিয়াউদ্দিন বরনি এবং সামস্ – ই – সিরাজ যথাক্রমে “ফুতুহ – ই – জাহান্দারী” ও “তারিখ – ই – ফিরোজশাহি” গ্রন্থ দুটি রচনা করেন। তিনি নিজেও তাঁর আত্মজীবনী “ফুতুহাৎ – ই – ফিরোজ শাহি” রচনা করেন। তাঁর বিদ্যানুরাগের আর একটি প্রমাণ হিসাবে বলা যায় যে, নগরকোট অভিযানের শেষে প্রায় ৩০০ টি (মতান্তরে ১৩০০ টি) সংস্কৃত গ্রন্থ তাঁর দখলে আসে। তিনি তাঁর সভাপতি আজিজউদ্দিন খালেদ কে দিয়ে এর মধ্যে বেশ কিছু পুঁথি ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এগুলি ‘দালাল – ই – ফিরোজেশাহি ‘ নামে সংকলিত হয়।
  • সুনির্মাতা হিসাবেও ফিরোজ শাহ তুঘলক কম কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না। ফেরিস্তার মতে, ফিরোজ ৫০ টি বাঁধ, ৪০ টি মসজিদ, ৩০ টি কলেজ, ২০০ টি শহর, ১৫০ টি সেতু সহ অসংখ্য বাগিচা, বিনোদন গৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ নির্মিত শহর গুলির মধ্যে অন্যতম হলো ফিরোজাবাদ, ফতেয়াবাদ, হিসার, ফিরোজপুর ইত্যাদি। বর্তমানে নিউ দিল্লির কোটলা ফিরোজ শাহ’র সেই সমৃদ্ধ নগরের অংশবিশেষ বলে চিহ্নিত হয়।
  • ফিরোজ শাহ তুঘলক ২৪ রকমের “আবওয়াব” বা অবৈধ কর বাতিল করেন এবং কোরানের নির্দেশ অনুযায়ী কেবলমাত্র চারটি কর ধার্য করেন। সেগুলি হলো খারাজ, খামস, জাকাৎ এবং জিজিয়া। জিজিয়া একমাত্র অ- মুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা হত। এর বিনিময়ে একজন অমুসলিম মুসলিম রাষ্ট্র বাস করার অধিকার পেতো। তিনি ব্রাহ্মণদের জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করেন । পরবর্তী কালে উলেমা’দের অনুমতি নিয়ে তিনি সেচ কর বা “হক – ই – শার্ব” আদায় করেন।
  • কৃষির উন্নতির জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করেন। এ ছাড়া দেড় শতাধিক কূপ খনন করে তিনি সেচ ও পানীয় জলের সুরাহা করেন।
  • ফিরোজ শাহ তুঘলক এক নির্ভরযোগ্য মুদ্রানীতি গ্রহণ করেন। খাঁটি সোনা ও রুপোর মুদ্রা চালু করে সরকারি মুদ্রার উপর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করেন। তাঁর চালু করা মুদ্রা গুলি হলো “জিতল”, অর্ধ জিতল বা “আধা” এবং সিকি জিতল বা “বিখ”।
  • ফিরোজ শাহ তুঘলক সরকারি পরিচালনাধীন ছত্রিশ’টি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কারখানা গুলো দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল : “রতিবি” ও “গয়ের রতিবি”। রতিবি গুলিতে মানুষ ও পশুর জন্য খাদ্যসামগ্রী তৈরি হতো আর গয়ের রতিবি তে তৈরি হতো পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য সামগ্রী। “মুতাসরিফ” নামে একজন করে কর্মচারী ছিলেন এইসব প্রত্যেক কারখানায়। তাঁর হাতেই এইসব কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো।
  • আলাউদ্দিন খলজি সাম্রাজ্যের যে স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন, তিনি তা ভেঙ্গে দেন। ফলে পুনরায় সুলতান সেনাবাহিনীর জন্য প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও মালিকদের উপর নির্ভরশীল হোয়ে পড়েন। আলাউদ্দিন যে ” দাগ” ও ” হুলিয়া” প্রথা প্রচলন করেন তিনি তাও বাতিল করেন। সেনাদের বেতনের পরিবর্তে জাইগির দানের রীতি পুনঃপ্রবর্তন করেন।
  • বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দিল্লিতে একটি কর্মসংস্থান সংস্থা ( Employment Bureau) প্রতিষ্ঠা করেন। দিল্লির কোতোয়াল কে বেকার যুবকদের একটি তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন।
  • ফিরোজ শাহ তুঘলক জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করে মূর্তিগুলি কে ভেঙ্গে চুরমার করে দেন।
  • কুতুবমিনারের সর্বোচ্চ স্তরগুলি বজ্রপাতে নষ্ট হয়ে গেলে তিনি তা মেরামত করেন।
  • হরিয়ানার মেরুত এবং টোপারা অশোক পিলারকে তিনি দিল্লীতে নিয়ে আসেন।
  • 'দেওয়ান-ই-বন্দেগান' বা ক্রিতদাস খানা তৈরি করেন।>/span>
  • সার হেনরি এলিয়ট তাঁকে ‘সুলতানি যুগের আকবর’ বলেন।
  • ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর মৃত্যু হয়।

পরবর্তী শাসকঃ

  • ফিরোজ শাহ তুঘলকের মৃত্যুর পর তাঁর জৈষ্ঠ পুত্র ফতে খানের পুত্র দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সিংহাসনে বসেন।
  • দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন ফিরোজ তুঘলক এর কনিষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহ। নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহ ছিলেন তুঘলক বংশের শেষ সুলতান।
  • তাঁর মৃত্যুর পর ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির ওমরাহ গণ দৌলত খাঁ লোদী নামে জনৈক আফগান ওমরাহ কে সিংহাসনে বসান। এরই সঙ্গে সঙ্গে ভারতে দুশো বছরেরও বেশি সময়ের তুর্কি শাসনের অবসান ঘটে।
  • দিল্লির অভিজাতদের একাংশ তৈমুরের প্রতিনিধি ও মুলতানের শাসক খিজির খাঁ কে দিল্লি দখলের পরামর্শ দেন। খিজির খাঁ ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লিতে এসে উপস্থিত হন। প্রায় চার মাস অবরুদ্ধ থাকার পর দৌলত খাঁ আত্মসমর্পণ করেন। সিংহাসনে বসেন খিজির খাঁ সৈয়দ।

সৈয়দ বংশ

খিজির খাঁ[1414-1421]

  • খিজির খাঁ নিজেকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মহম্মদ এর বংশধর বলে দাবি করতেন। এই কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশ সৈয়দ বংশ নামে পরিচিতি লাভ করে।
  • তিনি কখনোই “সুলতান” উপাধি গ্রহণ করেন নি। নিজেকে “রায়ত – ই – আলা” উপাধিতে ভূষিত করেন।

মুবারক শাহ[1421-1434]

  • খিজির খাঁ র মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র মুবারক শাহ।
  • তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়াহিয়া সিরহিন্দ “তারিখ – ই – মুবারক শাহি” নামক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
  • তাদেরই চক্রান্তে যমুনা নদীর তীরে নিজ নির্মীয়মান “মুবারকাবাদ” শহর পরিদর্শন কালে আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন।

মহম্মদ শাহ[1434-1444]

  • নিঃসন্তান মুবারক শাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ বিন ফরিদ “সুলতান মহম্মদ শাহ” উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।
  • মহম্মদ শাহ এর অকর্মণ্যতার সুযোগে দিল্লি ও তাঁর পার্শ্ব বর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দিলে সিরহিন্দ ও লাহোরের শাসন কর্তা বহলুল লোদী তাঁকে সামরিক সাহায্য দিয়ে বিপদ মুক্ত করেন। এজন্য তিনি বহলুল কে “খান – ই – খান” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং দিপাল পুর ও লাহোরের জায়গীর বহলুলের হাতে অর্পণ করেন।

আলম শাহ[1444-1451]

  • মহম্মদ শাহ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন “আলম শাহ” উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।
  • নিজের অদক্ষতা সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তিনি দিল্লির উপর বহলুল এর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে স্থায়ীভাবে বদাউনে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন।

লোদী বংশ

বহলুল লোদী[1451-89]

  • বহলুল লোদি ১৪৫১ সালে ১৯ এপ্রিল "সুলতান আবুল বাহলুল শাহ গাজী" উপাধি নিয়ে দিল্লির সালতানাতে বসেন।
  • বহলুল লোদী সৈয়দ বংশের শেষ সুলতান আলাউদ্দিন আলম শাহের জামাতা মালবের শাসক মামুদ শাহ শার্কি-কে দিল্লির সন্নিকটে নারেলা নামক স্থানে পরাজিত করে।
  • ১৪৮৯ সালে গোয়ালিয়র জয়ের পর দিল্লি ফেরার পথে অসুস্থ হয়ে মারা যান।

সিকন্দর শাহ লোদি[1489-1517]

  • বহলুল লোদীর মৃত্যুর পর আমির ওমরাহদের সহযোগিতায় তাঁর তৃতীয় পুত্র নিজাম খান “সিকন্দর শাহ লোদি” নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
  • আধুনিক ঐতিহাসিকরা তাকেই লোদী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলে উল্লেখ করেছেন।
  • ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা শহর স্থাপন করেন এবং আগ্রাতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
  • “গুলরূখ” বা “লালফুল ” ছদ্ম নামে সিকন্দর শাহ লোদি ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন।
  • নগর কোটের “জাভালামুখি” মন্দির ধ্বংস করে দেবমূর্তি গুলি কে তিনি টুকরো টুকরো করে কসাই খানায় বাটখারা হিসাবে ব্যাবহারের নির্দেশ দেন। তিনি হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর ও তীর্থ কর আরোপ করেন।

ইব্রাহিম লোদী

  • সিকন্দর লোদির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইব্রাহিম লোদি বিনা বাধায় সিংহাসনে বসেন।
  • অভিজাতদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য কিছু নীতি গ্রহণ করলে অভিজাতরা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা জালাল কে দিল্লির দিল্লির সিংহাসনে বসানোর উদ্যোগ নেয়। ফলে ইব্রাহিম ও জালালের মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং জালাল খাঁ পরাজিত ও নিহত হন।
  • পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদি এবং গুজরাটের শাসনকর্তা আলম খাঁ লোদী কাবুলের অধিপতি বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান।
  • ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর ইব্রাহিম লোদীকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতের বুকে তিন শতাব্দীর অধিক কাল স্থায়ী দিল্লি সুলতানির পতন ঘটিয়ে মোগল যুগের সূত্রপাত করেন।